
পাবলিক নিউজঃ কাঁকসা:– বাংলার সবার প্রথম কোথায় দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল তা হয়তো অনেকের জানা নেই।তবে ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, বঙ্গ ভঙ্গ হওয়ার বহুবছর আগে সেই সময় ভারতে শাসন করতেন বক্তিয়ার খিলজি। সময়টা ছিল প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি আগের। অবিভক্ত বাংলার শাসনে ছিলেন রাজা লক্ষণ সেন। বক্তিয়ার খিলজি বারবার রাজা লক্ষ্মণ সেনের উপর হামলা চালানোর কারণে, রাজা লক্ষ্মণ সেন তার সৈন্য নিয়ে লুকিয়ে পড়েন কাঁকসার গড় জঙ্গলে। এই জঙ্গল এতটাই বড় এবং ঘন ছিল যে লুকিয়ে পড়লে সহজে তার সন্ধান পাওয়া যেত না। সেই সময় এই গড় জঙ্গলে ছিল কাপালিকদের বাস। কথিত আছে, এই কাপালিকরাই শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। তবে, তখন দেবীর কোনও মূর্তি ছিল না, একটি পাথর খোদাই করে দেবীমূর্তি বানিয়ে তাকেই পুজো করতেন তারা। পুজোর সময় কাপালিকরা নরবলি দিতেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন গড় জঙ্গলে আত্মগোপন করার সময় সেই বছরেই কাপালিকরা সিদ্ধি লাভের জন্য ১০৮টি নরবলি দেবে বলে স্থির করেন। এরপর, সিদ্ধি লাভের জন্য নরবলিতে রাজা লক্ষ্মণ সেন বাধা দেবে বলে কাপালিকরা জানতে পান। কাপালিকরা রাজা লক্ষ্মণ সেনের শরণাপন্ন হন। তাঁরা তাকে বোঝান, রাজা লক্ষণ সেন যদি পুনরায় শক্তি বৃদ্ধি করতে চান তাহলে তাকেও এই পুজোতে থেকে দেবীকে প্রসন্ন করতে হবে, দেবী প্রসন্ন হলে তিনি আবার পুনরায় শক্তি ফিরে পাবেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন তাদের কথায় রাজি হলেও মাঝে এসে ব্যাঘাত ঘটান তার সভাকবি ‘কবি জয়দেব’। তিনি বলেন, দেবীর জাগ্রত হওয়ার প্রমাণ দিতে, তবে নরবলি হবে, নচেৎ বন্ধ করতে হবে। কাপালিকরা প্রমাণ দিতে না পারায়, কবি জয়দেব নিজেই দেবীর দুর্গা এবং কৃষ্ণের রূপ ধারণ করে নরবলি প্রথা বন্ধ করে দেন। তবে, দেবীর আরাধনা কপালিকরা কতদিন আগে শুরু করেছিলেন তা জানা নেই। কবি জয়দেব দ্বারা দেবীর দুটি রূপ দেখানোর পর থেকেই গড় জঙ্গলে দেবীর নাম হয় ‘শ্যামারূপা’। সেই থেকেই রাজা লক্ষ্মণ সেন পুনরায় পুজোর সূচনা করেন। তবে, দেবীর পাথরে খোদায় করা আসল মূর্তিটি বন্যায় ভেসে যাওয়ায়, পরে তার অনুকরণ করে একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেই চলতে থাকে দেবী দুর্গার পুজো। শোনা যায়, রাজা লক্ষ্মণ সেন মারা যাওয়ার আগে গড় জঙ্গল এবং দেবীর পুজোর দায়িত্ব – দিয়ে যান ইছাই ঘোষকে। পরে ইছাই ঘোষের সঙ্গে লাউ সেন ও কর্ণ সেনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মারা যান ইছাই ঘোষ। ইছাই ঘোষের পালিত কন্যার বিবাহ হয়েছিল কাশিপুর মহারাজের ছেলের সঙ্গে। কথিত আছে ইছাই ঘোষ মারা যাওয়ার পর তার পালিত কন্যা দেবী মূর্তি নিয়ে যাবার চেষ্টা করে গড় জঙ্গল থেকে। মূর্তি নিয়ে বরাকর নদী পার করার সময় মূর্তিটি পরে যায়। বহু খোঁজাখুঁজি পরও মূর্তিটি পাওয়া যায় নি। অগত্যা তারা খালি হাতে কাশিপুরে ফিরে যান। পরে ইছাই ঘোষের পালিত কন্যা সপ্নাদেশ পান। দেবী ওখানেই রয়েছে তাকে ওই জায়গাতেই প্রতিষ্টা করার নির্দেশ পান তিনি। সেই মতো কল্যাণীশ্বরী নামেই মন্দির করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তাই আজও শ্যামারূপার পুজো শুরু হওয়ার পর কল্যাণীশ্বরীতে পুজো শুরু হয়। নরবলি না হলেও আজও এখানে ছাগ বলি প্রথা চলে আসছে। এছাড়া সারা বছরই নিত্য সেবা হয় এখানে। বিশেষ করে পুজোর কয়েকটা দিন এখানে নরনারায়ণ সেবার আয়োজন থাকে। ঘন জঙ্গলের ভিতরে যাতে মানুষের যাতায়াতে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য গোটা জঙ্গল নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেয় কাঁকসা থানার পুলিশ। এখানে পুজোর আরও একটি আকর্ষণ হল অষ্টমীর দিন তোপের ধ্বনি শুনতে পাওয়া। তারপরেই শুরু হয় বলি প্রথা। শুধু শ্যামারূপা নয়। তোপের ধ্বনি শুনে বলি হয় জঙ্গলের আসে পাশের সমস্ত গ্রামে। আর এই তোপের আওয়াজ শোনার জন্য জেলা, রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় করেন এখানে। এখানে গাছের গায়ে ইঁটের টুকরো বেঁধে হয় মানসিক। মানসিক পূরণ হলে দেবীকে মানসিকের ফল মিষ্টি দিয়ে পুজো দেন ভক্তরা। তাবে, ভক্তদের আক্ষেপ যেহারে শব্দ দূষণ বেড়ে গেছে তাতে কোনটা বাজির আওয়াজ আর কোনটা তোপের আওয়াজ তা বুজে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে, জঙ্গলের ভিতরে কোথা থেকে এই তোপের আওয়াজ আসে তা আজও অনেক চেষ্টা করে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। শহরের পুজো ছেড়ে ঘন জঙ্গলের ভিতর গা ছমছম করা পরিবেশে এসে বাংলার প্রথম শুরু হওয়া দুর্গাপুজো দেখতে ও তোপের আওয়াজের সাক্ষী থাকতে, আজও হাজার হাজার ভক্তরা ভিড় জমান গড় জঙ্গলের এই শ্যামারূপার মন্দিরে।




Leave a Reply